ডেস্ক নিউজ : করোনাভাইরাস সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ উন্নত বিশ্বের বিরূপ অভিজ্ঞতায় এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাকে হুমকি হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা। তারা বলছেন, কিছুদিনের শিক্ষা কার্যক্রমের চেয়ে জীবনের নিরাপত্তাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্লাসে শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে পাঠদানের চিন্তা পরিহার করে ভিন্ন উপায় নিয়েই ভাবতে হবে। কারণ যত কিছুই করা হোক ক্লাসে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্বসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া একজন শিক্ষার্থী আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের ও পরিবারের মধ্যেও বাড়বে সংক্রমণ। তাই তাদের আশঙ্কার ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। সবকিছু বিবেচনায় আপাতত বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইন পাঠদানের কোনো বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু শিক্ষার চেয়েও জীবনের মূল্য অনেক। জীবনের ঝুঁকি রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়ে কোনোভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সুযোগ নেই। এটা ঠিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সামনাসামনি পাঠদানের সঙ্গে ভিন্ন কোনো কিছুর তুলনা হয় না। তার পরও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে যা বর্তমানে যা চলছে তা বিকল্প সম্পূরক প্রক্রিয়া।’ তিনি বলেন, ‘মরণব্যাধি করোনাভাইরাসে পুরো বিশ্বই থমকে গেছে। সংগত কারণেই বিশ্বব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আমাদের দেশেও কোনো বিকল্প ছিল না। এখনো বিকল্প নেই। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়ে কোনোভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সুযোগ নেই। দেশে শ্রেণিকক্ষের আকার ও শিক্ষার্থী সংখ্যা হিসেবে কোনোভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের ক্লাসে নেওয়ার সুযোগ নেই। যেসব দেশে ক্লাসে শিক্ষার্থী সংখ্যা কম তারা স্কুল খুলে দিয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, চীনসহ বিভিন্ন দেশ স্কুল খুলে দিয়ে ফের বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। যতক্ষণ না করোনা সংক্রমণের নিম্নমুখী যাত্রা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা সমীচীন হবে না। কারণ, নতুন প্রজন্ম আগামীর নেতৃত্ব দেবে। তাদের সংক্রমণের মধ্যে ফেলা ঠিক হবে না। যতটুকু পারা যায় অনলাইন পাঠদানের মাধ্যমেই যুক্ত রাখতে হবে।’
করোনা সংক্রমণের শীর্ষস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্সের প্রকাশিত প্রতিবেদনে মহামারীর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে প্রমাণ করা হয়েছে। গত জুলাইয়ে দুই সপ্তাহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ভয়ঙ্কর পরিণতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে সংগঠনটি। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ১ লাখ শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি দুই সপ্তাহের মধ্যেই করোনা আক্রান্ত হয়েছে ৯৭ হাজার শিশু। স্কুলে যাতায়াতের পথেই যে সংক্রমণ, প্রতিবেদনে তা নিশ্চিত করে বলা হয়েছে। ওই দুই সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে ২৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহে যদি প্রায় ১ লাখ শিশু কভিডে সংক্রমিত হতে পারে, তা হলে স্কুল চালু রাখলে সংখ্যাটা গিয়ে কোথায় পৌঁছবে তা নিয়ে শঙ্কিত সংগঠনটি।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদান চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বেতারের মাধ্যমেও শুরু হয়েছে প্রাথমিকের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠদান। আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনার পর দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠদান চালু রয়েছে। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। জাতিসংঘের শিক্ষাবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৩ শিক্ষার্থী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ৮২৫, প্রাথমিকে ৮৭ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩, মাধ্যমিকে ৮৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৬ ও উচ্চশিক্ষায় ১২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগে বাঁচতে হবে, তারপর শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। না বাঁচলে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠগ্রহণ করবে কীভাবে?’ তিনি বলেন, ‘কারিকুলাম আংশিক সম্পন্ন করে ওপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ করে দিলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে লার্নিং গ্যাপ তৈরি হবে। ক্রমে এ গ্যাপ বাড়তে থাকবে।’ এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘করোনার প্রকোপ একটু কমে এলে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায় তখন ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যত্নসহকারে পাঠদান করে মার্চে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে।’ ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘কারিকুলাম শেষ করার পর প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নিয়ে প্রমোশন দিলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এইচএসসিতে পরীক্ষা নিতেই হবে। কারণ, এ পরীক্ষার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার নানা বিষয় জড়িত।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়সূত্র জানান, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ থাকায় পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির এবারের সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করতে প্রস্তাব যাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে অটোপ্রমোশন, সিলেবাস কমানোসহ আরও কিছু বিষয়ও থাকবে এ প্রস্তাবে। সরকারের অনুমোদন পেলে এবার প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা নেওয়া হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোয় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম রয়েছে। সেখানে তো কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা যাবে না। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে কোনোভাবেই কমপ্রোমাইজ করা ঠিক হবে না।’ তিনি বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকটিতেই স্বল্পসময়ে শিক্ষকদের অনলাইনে ট্রেনিং দিয়ে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত করা হয়েছে। তারা সফলভাবে অনলাইনে পাঠদান করছে। শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও সন্তোষজনক। কিন্তু সেভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইন পাঠদান চলছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে অনলাইন ক্লাসে সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ, যারা পাঠদান করবেন তাদের আগে ডিজিটাল হতে হবে। শিক্ষকদের অ্যানালগ রেখে অনলাইন পাঠদান নিশ্চিত করা যাবে না।’ এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘যেহেতু করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাচ্ছে না, সেহেতু অনলাইনেই পাঠদান অব্যাহত রাখতে হবে।’
প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘এ মুহূর্তে অনলাইন পাঠের বিকল্প নেই, তাই এটিকেই শক্তিশালী করতে হবে। আমার মনে হয়, যদি ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে ডিজিটাল বৈষম্য ঘটবে, যা কোনোভাবেই উচিত হবে না এবং তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, শিক্ষার্থীদের অধিকারের প্রশ্ন আসবে। এজন্য শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। পদ্ধতিগতভাবে আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে, অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থী যারা অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে না, তাদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করা। সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সংযুক্তির সঙ্গে ল্যাপটপ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে যে কার্যক্রম চলছে, সেটিকেও বিস্তৃত করা যায়।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসূত্র জানান, করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট ডাটা সরবরাহ ও স্মার্টফোন সুবিধা নিশ্চিত করতে গত ২৫ জুন শিক্ষামন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কেনায় অসচ্ছল শিক্ষার্থীর তালিকা প্রণয়নে ৪৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। যাদের মোবাইল ডিভাইস কেনার আর্থিক সক্ষমতা নেই তাদের তালিকা ২৫ আগস্টের মধ্যে ইউজিসিতে পাঠাতে বলা হয়েছে।